বামনগাছির অবরোধের জেরে তত ক্ষণে প্রায় সমস্ত স্টেশনেই ট্রেন আটকে পড়েছে। বিড়া স্টেশনে সকাল আটটা আট মিনিটের বনগাঁ লোকালের এক কামরায় এক পুরুষ যাত্রী ফোন করে কাউকে একটা নির্দেশ দিলেন, ‘‘ওদের মেরে উঠিয়ে দে।’’ তার পর গজগজ করে বলতে শুরু করলেন, ‘‘মাতৃভূমি লোকাল বন্ধ করে ওটাকে পিতৃভূমি বানাতে হবে!’’ অন্য এক বয়স্ক যাত্রী চিত্কার করে সহযাত্রীদের উদ্দেশে বলতে শুরু করলেন, ‘‘এই কামরায় যে সমস্ত মহিলা যাত্রী আছেন, দয়া করে তাঁরা নেমে যান। এটা পুরুষদের কামরা!’’ কোণের দিকে দু’জন মহিলা ছিলেন, নেমে গেলেন। এর পর দত্তপুকুর স্টেশনে অবরোধ করে পুরুষ যাত্রীরা দাবি জানাতে থাকেন, মাতৃভূমি বাতিল করে সর্বসাধারণের জন্য ট্রেন চালু করতে হবে। লাইনের উপর তুলে দেওয়া হয় স্লিপার। পাথর জড়ো করে রাখা হয়। ঘণ্টাখানেক পর র্যাফ এবং কমব্যাট ফোর্স নামলে অবরোধ ওঠে।
সকাল...
more... ৯টা নাগাদ শিয়ালদহমুখী আর একটি মাতৃভূমি লোকাল ছেড়েছিল বারাসত থেকে। অভিযোগ, ওই ট্রেনের পুরুষযাত্রীরাও মহিলাদের কামরায় উঠে পড়েন। শুরু থেকেই দু’পক্ষের বচসা চলছিল। এরই মধ্যে বিশরপাড়া-কোদালিয়া থেকে ফের এক দল যুবক জোর করে মহিলাদের কামরায় ওঠে। এর মধ্যে বিশরপাড়ার বাসিন্দা দীপঙ্কর দে নামে এক যুবক বিরাটিতে নামতে গিয়ে পড়ে যান। ওই যুবকের দাবি, তিনি তাড়াতাড়িতে না দেখেই মহিলা কামরায় উঠে পড়েছিলেন। তাঁকে ধাক্কা মেরে কামরা থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। মহিলা যাত্রীরা ওই অভিযোগ অস্বীকার করেন। তাঁদের দাবি, ধাক্কাধাক্কিতেই পড়ে যান দীপঙ্কর। পুলিশ সূত্রেও খবর, যুবকের পা ছড়ে গিয়েছে। চলন্ত ট্রেন থেকে পড়ে গেলে যেমন চোট পাওয়ার কথা, তেমন প্রমাণ মেলেনি। কিন্তু দ্রুত ছড়াতে থাকে গুজব। বিশরপাড়া আর অশোকনগরে অবরোধ শুরু হয়। আর, বিরাটি মাতৃভূমি লোকালে শুরু হয়ে যায় তাণ্ডব। প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, এই হাঙ্গামায় নিত্যযাত্রীদের সঙ্গে যোগ দেন প্ল্যাটফর্মের হকার এবং স্থানীয় বাসিন্দারাও। একদল যুবক কামরায় উঠে গালিগালাজ করতে করতে মহিলাদের ট্রেন থেকে নামতে বলে। তরুণীদের ওড়না ধরে টানা হয়, গায়ে হাত দেওয়া হয়। মোবাইলে সেই ছবি তুলতে গেলে কয়েক জনের মোবাইলও কেড়ে নেওয়া হয়। প্রায় টানতে টানতে তাঁদের ট্রেন থেকে নামিয়ে দেয় যুবকেরা। সেই খবর বামনগাছিতে পৌঁছলে মহিলা যাত্রীদের সঙ্গে পুরুষ যাত্রীদের আর এক প্রস্ত ধস্তাধস্তি, মারপিট শুরু হয়।
ঘটনাটা এত দূর গড়াল কেন? চার দিনে তিন বার সিদ্ধান্ত বদলই তার মূল কারণ বলে মেনে নিচ্ছেন রেলকর্তাদের একাংশ। তাঁদের কথায়, ‘‘যে ভাবে পরপর নির্দেশ পরিবর্তন করা হয়েছে তাতে যাত্রীরা বিভ্রান্ত হয়েছেন।’’ এক প্রবীণ রেলকর্তার কথায়, ‘‘কোনও কিছু খতিয়ে না দেখে মাতৃভূমি লোকাল চালু করা হয়েছিল। তার নিয়ম বদলের সময়েও খামখেয়ালিপনা করা হয়েছে।’’ টানা কয়েক দিন বিজ্ঞাপন দিয়ে যাত্রীদের প্রতিক্রিয়া দেখে নেওয়া উচিত ছিল। যাত্রীদের কমিটির সঙ্গেও কথা বলা দরকার ছিল। কিছুই করা হয়নি। পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রবি মহাপাত্র অবশ্য বলছেন, ‘‘পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল। খড়দহে গণ্ডগোলের পরে রানাঘাট মাতৃভূমি নিয়ে সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়। তখন তো বনগাঁ নিয়ে ঝামেলা হয়নি। এখন কেন হচ্ছে! রেল তার বিজ্ঞপ্তি থেকে সরছে না।’’
এমতাবস্থায় মহিলাদের দাবি, মাঝখানের ৩-৪টি কামরায় পুরুষদের উঠতে দিলে বাস্তবে গোটা ট্রেনটাই পুরুষদের দখলে চলে যাবে। যেমন এ দিন মহিলা কামরায় জোর করে পুরুষরা উঠেছিলেন বলে অভিযোগ। তার থেকেই এ দিনের গণ্ডগোলের সূত্রপাত। আর পুরুষদের দাবি, মাতৃভূমি ফাঁকা থাকলেও তাঁরা ওঠার সুযোগ পাবেন না, এটা ঠিক নয়। বছর কয়েক আগে মেট্রোতেও মহিলা কামরা চালু নিয়ে গোলমাল বেধেছিল। পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আগেই মেট্রো সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয়। এ বারের গোলমাল বাড়ার পিছনে রেল পুলিশের গাফিলতির কথা তুলেছেন অনেকে। যদিও জিআরপি কর্তারা বলছেন, একসঙ্গে একাধিক জায়গায় অবরোধ সামাল দেওয়ার মতো পুলিশ তাদের হাতে নেই। মহিলা বিক্ষোভকারীদের হঠানোর জন্য প্রয়োজনীয় মহিলা পুলিশও নেই। পরিকাঠামোগত খামতির কারণেই অবরোধ তুলতে দেরি হয়েছে।